এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামানিক
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত কুষ্টিয়াকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটার বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে তা আজও সম্ভব হয়নি। অথচ রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য শিলাইদহের কুঠিবাড়ি এবং বাউল সম্রাট লালনের সাধনভূমি ছেউরিয়াকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের যুগযুগ ধরে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে চলেছে। এর বাইরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের বাস'ভিটা, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার, বাঘা যতীন, ডঃ রাধা বিনোদ পালের স্মৃতিচিহ্ন, রবীন্দ্রনাথের টেগরলজ, মোহিনী মিল, রেণউইক যজ্ঞেশ্বর বাঁধ, ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ, দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পের প্রধান পাম্প হাউজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং লালন শাহ সেতুকে ঘিরে সব সময় মুখরিত থাকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদচারণা। ইচ্ছে করলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঃ
কুষ্টিয়া শহর থেকে ১ ঘন্টারও কম সময়ে যাওয়া যাবে কুঠিবাড়ি। চারদিকে বাগান বেষ্টিত এ মনোরম পরিবেশে আপনার সারাদিন থাকতে ইচ্ছা করবে। কুঠিবাড়ির ভেতরে কবিগুরুর ব্যবহার্য বিভিন্ন আসবাবপত্র, বাইরে বকুলতলার পুকুকঘাট এবং পাশ্ববর্তী পদ্মার পাড়ও আপনাকে মুগ্ধ করবে। পুরো বাড়িটা আমবাগানে ঘেরা। বাড়ির চারপাশে ঢেউ খেলানো দেয়াল, যেন পদ্মারই ঢেউ। পাশে বকুল তলার শানবাঁধানো পুকুর ঘাট, জায়গাটা এখনো কোলাহলপূর্ণ। বাড়ির সামনে শান-বাঁধানো উন্মুক্ত বৈঠকখানা যেখানে প্রজারা এসে বসতো সেই সময়। বাড়ির পেছনে টেনিস কোর্ট। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে বড় বড় কয়েকটি কক্ষ, সোফাসজ্জিত ড্রইংরুম। পড়াশোনার টেবিল, চেয়ার, শোবার ঘর বিছানো খাট, বড় আলমারী, বুকসেলফ, আরাম কেদারা, স্নানের চৌবাচ্চা, বিশালাকার কমোড বিশিষ্ট বাথরুম। জানালা খুললে উপনের দুই বিঘা জমি, সেই তাল গাছের স'ান। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক পর্যন- প্রশস- কাঠের ঝুলবারান্দা, সামনে চওড়া বারান্দায় আছে একটি বড় সিপ্রডবোর্ড, তিনতলার ছাদে উঠলে চোখে পড়ে পদ্মার চর, কখনোবা ঢেউয়ের খেলা। শুধু যা নেই তা হল কবির পদচারণা, কোলাহলমূখর সেইসব অতীত। পদ্মা-গড়াই-হিশনার শীতল স্রোতে প্লাবিত এই অঞ্চল। এখানকার জনপদের ইতিহাস এক নদীর মতোই উদার, মহান ও বিশালতাই পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছিলেন প্রথমে জমিদারী দেখাশোনা করার কাজে। জমিদার রবীন্দ্রনাথ মিশে গিয়েছিলেন শিলাইদহের প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। তার প্রতিটি লেখায় মুর্ত হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের কথা। হয়তো শিলাইদহের অকৃত্রিমতাই মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়ে উঠেছিলেন আকাশ ভরা সূর্যতারা/ বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে, আমি পেয়েছি মোর স'ান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥ শুধু জমিদারিত্বই নয় এই শিলাইদহ ছিল রবী ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অপূর্ব প্রেরণা। এখানে তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত হয়েছিল এখানেই এমনকি গীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গল্প। এমনকি গীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় এই শিলাইদহে। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন- রীবন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন শিলাইদহে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে কখনও স্বল্প কখনও দীর্ঘ সময় থেকেছেন এখানেই। এসেছেন একাকী কিংবা স্বপরিবারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোর্ডে, পালকিতে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহ কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তার লেখাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখানে সে সময় আবির্ভাব ঘটেছিল বড় বড় প্রভাবশালী মহৎ সব ব্যক্তিত্বের। তাই তিনি আবেগ ভরা কন্ঠে বলেছিলেন ......... ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি। রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশাতে ১৩৪৬ সালের ১ চৈত্র শিলাইদহ পল্লী সাহিত্য সম্মেলনে সম্পাদককে লিখেছিলেন আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস সাধনার তীর্থস'ান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহের পল্লীতে। এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ সেই বাড়িটি এখন এক স্মৃতিচিহ্ন জাদুঘর। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে মানুষ পেতে পারে অতীতের সেই সোনালী স্পর্শ। এখানে আছে কবির আঁকা ছবি ও লেখা। এছাড়াও আছে কবি ব্যবহৃত পালকি, ছয় বেহারার পালকি, চার বেহারার পালকি। আছে বিট্রিশ আমলের ঘাস কাটার যন্ত্র, কিছু দূর্লভ পেপার কাটিং ও কবির নিজ হাতে লেখা চিঠি। মূল বাড়ির বাইরে একটি বিশাল আকার মঞ্চ আছে। প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্ত্রী (২৫ বৈশাখ) এখানে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। দেশ-বিদেশ থেকে রবীন্দ্র ভক্তরা যোগ দেয় এ অনুষ্ঠানে। ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে এখানে বসে তিন দিনের মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে লোক সমাগম হয় প্রচুর। সবর হয়ে ওঠে কুঠি বাড়ি। ইচ্ছে করলে কুঠিবাড়ি সংলগ্ন খোরশেদপুরে গ্রামের কামেল কিংবদনি- পুরুষ হজরত খোরশেদ উল মৌলুকের মাজারও ঘুরে আসতে পারেন।
লালন শাহের মাজার ঃ
শহরসংলগ্ন কালিগঙ্গা নদীর তীরে লালনের সাধনভূমি ছেউড়িয়া গ্রাম। এখানেই লালন শাহ এবং অন্যান্য সাধুর মাজার ও লালন মিউজিয়াম। এই মাজারে প্রবেশ করতেই হয়তো আপনার মনে বেজে উঠবে সেই মরমী সুর ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর সেখা এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে .............।’ ঃ কোন এক অচিন গায়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন জীবনভর সন্ধান করেছেন অচিন পাখিকে, সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান-
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
ফকির লালন কয়
জাতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে’
সব জাতের সব শ্রেণীর মানুষের মিলন হয় কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে। প্রতিদিনই এখানে বসে ভবের হাট। গুরু-শিষ্যর ভাবের আদান প্রদান যেমন হয়, তেমনি চলে জীবনের তিরোধান, ভাব সাধন, আর দেহতত্ব নিয়ে অপূর্ব সূর মূর্চ্ছনা। সাধু-ভক্তদের পাশাপাশি বাউল সম্রাটের মাজারটি টানেও আসেন ঝাঁক ঝাঁক পর্যটকের দল। আসেন দেশী-বিদেশী গবেষকগণও । লালনের খ্যাতি এখন শুধু এই কুষ্টিয়ায় নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। লালনের চিন-া, আদর্শ, জীবনকর্ম এবং সংগীত এখন পৃথিবী জুড়ে গবেষণার বিষয়বস'তে পরিণত হয়েছে।
‘অনায়াসেই দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁই বারাম খানা’
সাঁইজির এ বারামখানার সন্ধ্যানে মানুষ ছুটে চলেছে সাঁইজির ধামে। যে কোন সময়ের চেয়ে আখড়াবাড়ি এখন অনেক বেশি মুখরিত। আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দুর-দুরান- থেকে ভক্ত অনুসারীরা এখন এখানে আরো বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়, সংগীত, ভক্তি প্রদানে কোন সমস্যা হয় কিনা দেখভাল করার জন্য লালন একাডেমির সদস্যরা সবসময়ই নিয়োজিত। তাছাড়াও এখানে এখন নেয়া হচ্ছে নানান কর্মসূচী। নবীন শিল্পীদের সংগীত প্রশিক্ষণ, লালন গবেষনা, অডিটরিয়াম ও বিশালাকার ফাঁকা মঞ্চে নানা অনুষ্ঠানের প্রায় সবসময় মুখর থাকে এ তীর্থস'ান। লালন অনুসারী বাউলরা এ মাজারকে তাঁদের ধর্মীয় তীর্থস'ান হিসেবেই মানেন । লালন ভক্তরা এখানে পরম শ্রদ্ধায় প্রার্থণা করেন। এ মাজারে একবার মাথা নোয়াতে পারলেই বাউল ধর্মাবলম্বীরা পুরো জীবনই ধণ্য মনে করেন। মানব ধর্মের প্রচারক লালন শাহ’র মাজার ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল অডিটরিয়াম ও একাডেমি কমপ্লেক্্র। পাশের কালীনদী ভরাট করে বানানো হয়েছে বিশালাকার খোলার মাঠ।সাথে রয়েছে সুদর্শন মঞ্চ। তবে বড় বড় দালান কোটা উঠলেও লালনের মাজারে ভক্তদের প্রার্থণার রেওয়াজ পাল্টায়নি আজো। এখনও ভক্তরা আসন পেতে বসেন। একতারা হাতে গাইতে থাকেন সারাণ। আর সন্ধ্যা গড়ালেই শুরু হয় ভাব সংগীতের মূর্চ্ছনা। যে কোন পর্যটক বা অতিথি আসলেই গান দিয়ে বরন করে নেন একাডেমির শিল্পীরা। অডিটরিয়ামের ফাঁকা নীচতলায় এজন্য তারা একতারাসহ অন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে দল ধরে অপেক্ষায় থাকে। মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিদেশী কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তি কুষ্টিয়ায় কোনো জরুরী কাজেও যদি আসেন, যদি তার কর্মসূচী খুব টাইট থাকে তবুও লালন আখড়ায় একবার বেড়াতে যাননি এমন ঘটনা বিরল। এখানে আসলেই অহিংস লালন ভক্তদের সীমাহীন বিশালতায় ও জাতহীন ভাবগাম্ভীর্যে মন ভরে ওঠে। মাজারে একবার ঢুকলে আর বের হতে মন চায় না। লালনের জীবদ্দশা থেকে এখানে চলে আসছে চৈত্রের দৌল পূর্ণিমা উৎসব। এখন লালনের মৃত্যু বার্ষিকীতে (১৬ অক্টোবর) আরেকটি স্বরণোৎসব বসে। বছরের এ দু’টি উৎসবের দিনগুলিতে প্রতিদিনই লাখো মানুষের ঢল নামে । একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাাঁশির সুরে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। দুর-দুরান- থেকে আসা বাউলরা দরদভরা কণ্ঠে গেয়ে চলেন লালনের রেখে যাওয়া সব আধ্যাত্মিক গান। তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করেনা ভক্তরাও। উৎসবকে ঘিরে লালন ভক্ত অনুসারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম উন্মাদনার। লালন একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান বলেন, লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিসং ভাব ও অসাম্প্রাদায়িক চেতনার কারনে দিন দিন লালনের গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তিনি মনে করেন, আমরা লালনকে নিয়ে অনেক মাতামাতি করি ঠিকই কিন' তার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারি নাই। আমাদের দাবী লালনের গান কবিতা আকারে আমাদের পাঠ্যপুস-কে অন-র্ভূক্ত করা হোক। আগত অতিথি ও সাধু বাউলেদের জন্য লালন মাজারে একটি রেষ্ট হাউজ নির্মান করাও জরুরী।
কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন দক্ষিন-পূর্বে, কুমারখালী উপজেলার পশ্চিম সীমানে- ছেউড়িয়া গ্রামে মরা কালী নদীর তীরে লালন শাহ’র মাজার। কুমারখালী উপজেলার মধ্যে অবসি'ত হলেও মাজারটি কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। এখানকার সুদৃশ্যমান বিশাল প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে পূর্বদিকে কিছু দূর এগুলেই লালন শাহ এর সমাধি। বিশাল গম্বুজের মধ্যে লালন ও তাঁর স্ত্রী চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। সমাধি ঘিরে রয়েছে সারি সারি শিষ্যদের কবর। এটাকেই মূল মাজার বলা হয়। লালন ভক্ত-অনুসারীরা পরম শ্রদ্ধায় প্রার্থণা করেন। এই মাজারটিই বাউল ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস'ান। দেশ-বিদেশের লালন ভক্তরা কুষ্টিয়ায় ছুটে আসেন এ মাজারের টানেই। যদিও এই মাজার চত্বর আর আগের মতো নেই। এখানে শহুরে ভাব এসেছে, তবুও ভালো লাগবে আপনার। এখানে বসে বাউলের গান শুনে প্রাণ জুড়িয়ে নিতে পারেন।
মীর মোশাররফের বাস'ভিটা ঃ
উনিশ শতকের অন্যতম মুসলিম সাহিত্যিক, ‘বিষাদ সিন্ধুর’ রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেনের বাস'ভিটা লাহিনীপাড়ার দুরুত্ব মাত্র ২০ মিনিটের। ১৮৪৭ সালে জন্ম নেওয়া মহান এই সাহিত্যিকের শৈশবের অনেক স্মৃতিই খুঁজে পেতে পারেন এখানে। মীর মশাররফ হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে এই লাহিনীপাড়া গ্রামে। তার আত্মচরিত ‘আমার জীবনী গ্রন'’ পাঠে জানা যায়, ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্য গুরু। হরিনাথ মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ এবং ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামক পত্রিকা দুটিতে মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় বলে জানা যায়। তার বাবা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন এই এলাকার এক সম্ভ্রান- ব্যক্তিত্ব। মীর মশাররফ হোসেন প্রথমে জগমোহন নন্দীর পাঠশালায় পড়াশুনা শুরু করেন এরপর তিনি কুমারখালী এম.এন স্কুল, কুষ্টিয়া হাইস্কুল এবং রাজবাড়ী জেলায় পদমদী স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। পরে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। আনুমানিক ১৮৬০ সালে মশাররফ হোসেনের মা দৈলতুন্নেসা ইনে-কাল করেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি কলকাতায় তার পিতৃবন্ধু নাদির হোসেনের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেন। এখানে অবস'ান কালে নাদির হোসেনের বড় মেয়ে লতিফুন নেসার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং পরে বিবাহ করেন। কিন' বিয়ের সময় বড় মেয়ের পরিবর্তে মেজো মেয়ে আজিজুন নেসার সাথে মশাররফ হোসেনের বিয়ে হয় নাদির হোসেনের দুরভি সন্ধিতে। এ ঘটনায় লতিফুন নেছা আত্মহত্যা করেন। এ বিয়ে সুখের না হওয়াই তিনি ৮ বছর পর কুমারখালী উপজেলায় সাঁওতা গ্রামের এক বিধবার কন্যা কুলছুমকে বিয়ে করেন। ফলে স্ত্রী আজিজুন নেছার সাথে তার মনোমালিন্য আরও তীব্র হয়। এরপর তিনি লাহিনীপাড়া ছেড়ে টাঙ্গাইলে চলে যান। সেখানে তিনি শানি-তে বসবাস করতে থাকেন। আজিজুন নেছা কয়েক বছর নিঃসঙ্গ থাকার পর লাহিনী পাড়াতেই মারা যান। মশাররফের প্রথম পক্ষের কোন সন-ান ছিল না। তার ৫ পুত্র ও ৬ কন্যার সবাই ছিলেন কুলছুম বিবির গর্ভজাত। ১৯১১ সালে পদমদী গ্রামে যাবার পথে পাংশায় কুলছুম বিবি মারা যান। এর কিছুদিন পরই একই বছরের ১৯শে ডিসেম্বর বর্তমান রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি থানার পদমদী গ্রামে কুলছুম বিবির সমাধির পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম সাহিত্যিকদের অন্যতম কীর্তিমান পুরুষ মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তার নিপুন হাতের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, জীবন চরিত্র, আত্মজীবনী প্রবন্ধ ও ধর্ম বিষয়ক প্রায় ৭৬টি গ্রন' রচনা করেছেন। এছাড়া জমিদার দর্পণ, বিবি কুলছুম, রত্নাবতী ও বসন-কুমারী নাটক তার অনন্য সৃষ্টি।
কাঙ্গাল কুঠির ঃ
শহর থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্ব কুমারখালী উপজেলা। এই উপজেলা শহরের মধ্যখানে অবসি'ত। কুষ্টিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশিকা’র সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি ‘কাঙ্গাল কুঠির’। ১৮৬৩ সালে কুমারখালীর বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক কাঙ্গাল হরিনাথ এম এন প্রেস থেকে এই পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেন। গাছ-গাছালিতে ভরপুর এই কাঙ্গাল কুঠিরে আপনি দেখতে পাবেন কাঙ্গালের শেষ স্মৃতিচিহ্ন, যা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নিঃশেষ হতে চলেছে। এই গ্রামবার্তা প্রকাশিকাতে এক সময় নীলকরদের বিরুদ্ধে এবং অত্যাচারী জমিদার ও লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে কাঙ্গাল হরিনাথ কলম ধরেছিলেন। হরিনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৩৩ সালে, মৃত্যু ১৮৯৬ সালে। অল্পবয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স'ানীয় ইংরেজি স্কুলে পড়ালেখা শুরু। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে বেশিদূর এগোতে পারেননি। বিদ্যানুরাগ ছিল প্রবল। সমাজ-সচেতনতাও প্রখর। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স'াপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা অন্যতম পথিকৃতের।
স'ানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়ন ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল হরিনাথকে। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স'াপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। মেশিনের মাঝখানে এ যন্ত্রটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনের তারিখে লেখা রয়েছে। লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কলম্বিয়ান প্রেস মডেলের ১৭০৬ নম্বর এ মুদ্রণযন্ত্রটি তৈরি করা হয় ১৮৬৭ সালে। প্রয়াত এডওয়ার্ড বিভান এ যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। অমৃতবাজার পত্রিকার বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যায় কুমারখালীতে কাগজ ছাপা কল বসার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খবর লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অসংখ্য লোক তাই দেখতে আসে কেমন করে কাগজের গায়ে অত ছোট লেখা হয়। ৩০-৩৫ মণ ওজনের ডাবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। দেখতে একটি দানবের মতো। এ মেশিনে কাগজ ছাপাতে তিনজন লোক লাগত। মেশিন চলাকালে দেখা যেত মেশিনের মাথার ওপর ডানা প্রসারিত ঈগল পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার যথাস'ানে ফিরে আসছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা এ প্রেস দেখতে আসেন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখা হয়নি। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন' মানবদরদি ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। কাঙালের জীবনীকার অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, এই শোষণের প্রতিকারের চিন-া থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসঙ্গীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রিয় বন্ধু কাঙালকে শায়েস-া করতে পাঞ্জাবি লাঠিয়ালদের কলকাতা জাঁকিয়ে দিয়েছিলেন।
গ্রামবার্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন- সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তাঁর ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।
ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন- ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ ছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণ-এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন তাঁর শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্তার লেখক। হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন' ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন-’ নামের উপন্যাসটি অত্যন- জনপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশাতেই।
পূর্বপুরুষের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি অশোক মজুমদার। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে প্রেসঘরটির ওপরে পাকিস-ানি হানাদারেরা বোমা ফেলেছিল। যন্ত্রটি রক্ষা পেলেও ঘরের ছাদ দেয়াল ভেঙে যায়। মেরামত করার সামর্থ্য নেই। এখানেই মাথা গুঁজে আছেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। ‘ডবল ক্রাউন’ সাইজের কাগজে এই মুদ্রণযন্ত্রটিতে সারা দিনে প্রায় এক হাজারটি ছাপ দেওয়া যায়। ‘যে যন্ত্রে কাঙালের হাতের স্পর্শ, লালনের হাতের স্পর্শ, মীর মশাররফ, জলধর সেনের হাতের স্পর্শ, সেখানে আমি হাত রাখতি পারিছি, এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি আছে’, বলছিলেন অশোক। সে কারণেই যন্ত্রটি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন।
‘কাঙাল’ বলেই সবার কাছে পরিচিত হরিনাথ মজুমদার। অশোক বাবু জানালেন, কাঙাল হরিনাথের একটি গান সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত পথের পাঁচালী ছবিতে। কিন' গানটি কার সে উল্লেখ ছিল না ছবির পরিচিতি অংশে। পরে এ সম্পর্কে জেনে চিঠি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। খুব পরিচিত গান। পথের পাঁচালীর আবহ সংগীতে ঘুরেফিরে ব্যবহূত হয়েছে, আর ইন্দির ঠাকরুনের ভূমিকায় চূনীবালা গেয়েছিলেন গানটি ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে...। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি বলে লোক শিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংসৃ্কতিচর্চার একটি অনুূূকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন' উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস- হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসাবে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর চলেছিল। তখনো তিনি তার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। এলাকার সুধীজনদের অভিমত, আমাদেও দেশে জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিউট বা সাংবাদিকতা বিভাগে রয়েছে- এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে কি কাঙাল হরিনাথের এ প্রেসটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে না? ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে কাঙাল হরিনাথ পরিষদের পক্ষ থেকে এর সভাপতি কামাল লোহিনী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকী এ ধরনের উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। কিন' দুঃখজনকভাবে কাঙালের বংশধরদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাননি তারা। হরিনাথ মজুমদারের প্রপৌত্র অশোক মজুমদারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, জাদুঘর বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসটি সংরক্ষণের ব্যবস'া নেয়া হলে তার কোনো আপত্তি আছে কিনা। তখন তিনি জবাব দেন আমার বেনিফিট কোথায়? স'ানীয় জনসাধারণসহ সবার অভিমত, কাঙাল হরিনাথের এ প্রেস একটি জাতীয় ঐতিহ্য। জমি সংক্রান- বিরোধের কারণে এ সম্পদটি ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। সে কারণেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সংরক্ষণ হওয়া উচিত।
টেগর লজ ঃ
কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় অবসি'ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান টেগর অ্যান্ড কোম্পানীর এ দেশীয় শাখা অফিস টেগর লজ। কবিগুরু কলকাতা থেকে শিলাইদহে আসার পথে এই টেগর লজে বিশ্রাম নিতেন। বাড়িটি শহরের মিলপাড়ায়। জায়গা খুব বেশি নয়, সাকল্যে নয় কাঠা। তার ওপরে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। উত্তর-দক্ষিণ দুই পাশেই বারান্দা। পশ্চিম পাশের কুঠুরির কোণে দোতলায় ওঠার প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি। বাড়িতে প্রবেশের পথ অবশ্য উত্তর দিকে। একেবারে মিলপাড়ার সড়কের সঙ্গে লাগোয়া। বাড়িটির নাম ‘টেগর লজ’। ছোট্ট বাড়িটি মাপে ছোট হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য হওয়ার কারণে মর্যাদা ও গৌরবে এক বিশালতা জুড়ে থাকলেও কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির যেমন বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি, সে তুলনায় শহরের ভেতরের এই বাড়িটি এখনও প্রায় অপরিচিতই বলা যায়।
ভুসিমালের কারবারের সঙ্গে এখানে কবি আখ মাড়াইকল ও পাটের গাঁট তৈরির কলও স'াপন করেছিলেন। পরে স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় টেগর লজকে কেন্দ্র করে একটি বড় তাঁতশালাও গড়ে তোলেন। কবিকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতেন তাঁর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমটায় ব্যবসা ভালো চললেও পরে টেগর অ্যান্ড কোম্পানি ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। পাটের কারবার করতে এসে কবি লাখ টাকার ওপরে ঋণগ্রস- হয়ে পড়েন। উপায়ান-র না দেখে তিনি শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহির উদ্যমী যুবক যজ্ঞেশ্বরকে ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব দেন। যজ্ঞেশ্বর বহু খেটেখুটে ডুবতে বসা টেগর অ্যান্ড কোম্পানিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে কবি তিন হাজার টাকায় যজ্ঞেশ্বরকে কোম্পানির সমুদয় যন্ত্রপাতি ও মালামাল দান করে দেন এবং টেগর লজসহ এখানকার দুই বিঘা জমি বছরে ৫০ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস- করে দেন। পরে যজ্ঞেশ্বর এখানে ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন (কারখানা ভবনটি এখনো আছে)। তারপর তো কেটে গেছে বহু দিন। একপর্যায়ে টেগর লজ বেদখল হয়ে যায়। বহু হাত বদল হয়ে অবশেষে এর মালিকানা এসে পৌঁছায় স'ানীয় আবদুল গফুরের স্ত্রী ছালিমা খাতুনের নামে। আশপাশের জমিও চলে গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে। তাঁরা নিজেদের নামে কাগজপত্র করে নিয়েছেন। এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেয়া হয়। নিচের তলায় একটি বড় হলঘর ও একটি ছোট ঘর। ওপরে ঘর তিনটি। ওপরের তলায় মাঝের ঘরটি বড়। এখানে একটি আলমারিতে রাখা আছে কবির রচিত গ্রন'মালা। দেয়ালে ঝোলানো কবির আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি। দক্ষিণে সবুজ ঘাসে ঢাকা একচিলতে আঙিনা। সেখানে ছোট্ট একটি মঞ্চও আছে। উত্তরের প্রবেশপথের সামনেই কবির আবক্ষ মূর্তি। এই মূর্তি ও ছবির অনুকৃতিগুলো ভারতীয় দূতাবাস দান করেছে বলে জানালেন টেগর লজের তত্ত্বাবধায়ক এস এম নূরুদ্দিন। ওপরতলায় আসবাবের মধ্যে আছে কয়েকটি চেয়ার ও হেলান দিয়ে বসার একটি লম্বা বেঞ্চ। এগুলো শিলাইদহের আসবাবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। জরাজীর্ণ দেয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিল না বাড়িটিতে। কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী বললেন, ‘শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সুপরিচিত হলেও টেগর লজকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে কবির যে সম্পর্ক, তা অনেকেরই অজানা। ফলে টেগর লজ আজও উপেক্ষিত। টেগর লজকে অনতিবিলম্বে রবীন্দ্র জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তিনি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রলালয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে ঘিরে কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাদপীঠ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
মোহিনী মিলস ঃ
লাল টকটকে দ্বিতল টেগর লজ এই ভবনটির পেছনেই রয়েছে অবিভক্ত বাংলার প্রথম ও প্রধান বস্ত্রকল ‘মোহিনী মিলস’। সমপ্রতি চালু হওয়া এই মোহিনী মিলও আপনি ঘুরে দেখতে পারেন। কথিত আছে, মোহিনী মিলের হুইসেলের শব্দ শুনে এলাকাবাসী তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করতেন। ভারতের প্রখ্যাত সুতা ব্যবসায়ী মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ব্যবসার কাজে বেশ কয়েকবার কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন। নদীপথে নিরাপদ যাতায়াত আর উন্নত রেল যোগাযোগের কারণে তিনি কুষ্টিয়ার বড় স্টেশন সংলগ্ন জায়গায় একটি সুতা মিল স'াপনের উদ্যোগ নেন। পরে ১৯০৮ সালে মিলপাড়া এলাকায় ১০০ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করেন মোহিনী মিল। সে সময় সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পিতলের হ্যান্ডলুম মেশিন আর পিতলের তৈরি প্রায় ২০০ তাঁত আমদানি করে বসিয়েছিলেন মোহিনী মিলে। এ সময় ভারতবর্ষের কয়েকটি জায়গায় এ ধরনের আধুনিক সুতার কল ছিল। এর মধ্যে মোহিনী মিল ছিল অন্যতম। এখানে প্রায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করতেন। এ মিলে উৎপাদিত সুতা ভারতবর্ষের সব প্রদেশ ছাড়াও বার্মা, পাকিস-ান ও শ্রীলংকায় যেতো।
সে সময় প্রতিদিন কুষ্টিয়া বড় স্টেশনে ভারতের শিয়ালদহ থেকে কয়েকটি বগি রিজার্ভ আসতো মোহিনী মিলের সুতা নেয়ার জন্য। আবার বড়বাজার গড়াই নদীর ঘাট থেকে বড় বড় নৌকায় সুতা যেতো দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পাবনা, শাহজাদপুর, গাজীপুর, নাটোরসহ দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে তাঁতিরা এখানে আসতেন সুতা কিনতে। মোহিনী মিলের এ গোল্ডেন যুগ একটানা ১৯৬৫ সাল পর্যন- চলে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে পশ্চিম পাকিস-ানিরা এ দেশে হিন্দু সম্পত্তির ওপর একটু বাঁকা নজর ফেলতে থাকে। ’৬৫ সালের শেষের দিকে মোহিনী মিলের মালিক মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর ওপর নেমে আসে সামপ্রদায়িক থাবা। রাতের আঁধারে মিলের ভেতর প্রবেশ করে লুটপাট চালিয়ে মালিক পক্ষকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় পাকিস-ানি দোসররা। একদিন প্রাণভয়ে রাতের আঁধারে শুধু স্ত্রী, সন-ানকে নিয়ে মিলের মৌখিক মালিকানা স্বত্বের বিনিময়ে সব কিছু ছেড়ে এ দেশ ছাড়তে হয় মোহিনী বাবুকে। এর পরে পাকিস-ানি দোসরদের ইশারায় মিলের এমডি কানু বাবু মোহিনী মিলের সর্বময় কর্তা বনে যান। এর মধ্যে চলে আসে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ। স্বাধীনতাযুদ্ধে কানু বাবুরা এ দেশ ছেড়ে চলে যান। মালিকানাহীন মিলটি পড়ে থাকে বেশ কয়েক বছর।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭নং আদেশ বলে মিলটি জাতীয়করণ করে বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশনের পরিচালনায় ন্যস- করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন চালু থাকার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়। অত্যধিক লোকসানজনিত কারণে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চালানোর অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ১৯৮১ সালের ১২ জুনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে মিলটি গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান- নেয়া হয়। ১৯৮২ সালের ৫ ফেব্রয়ারি মিলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে মিলটির সথাবর/অস'াবর সম্পত্তি বিক্রি করে দায়-দেনা মেটানোর জন্য একজন লিকুইডেটর নিয়োগ দেয়া হয়। মিলটির স'াবর/অস'াবর সম্পত্তি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ দরদাতা নজরুল ইসলামের কাছে ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় এক বিক্রয় চুক্তিমূলে ১৯৮৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হস-ান-র করা হয়। ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারি এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তিমূলে গুটানো মোহিনী মিলের হস-ান-রিত সম্পত্তির ক্রেতা নজরুল ইসলামের স'লে মেসার্স শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নামে গ্রহণ করা হয় এবং ওই কোম্পানি নজরুল ইসলামের স'লাভিষিক্ত হয়। ক্রেতা কোম্পানি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বন্ধক রেখে এবং গুটানো মোহিনী মিলের সম্পত্তির ওপর ২য় চার্জ সৃষ্টি করে অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া বড়বাজার শাখা হতে প্রায় ৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। কিন' মিলের পুরনো অংশটি পুনরায় চালু করার শর্তজুড়ে দেয়ার কারণে কাঙ্খিত ও গুণগত উৎপাদন না হওয়ার ফলে মালিকপক্ষকে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়। এ লোকসানের কারণে ১৯৮৮ সালের ২৫ মে মিলটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে কুষ্টিয়ার এ ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিলটি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন মোহিনী মিলসহ সব বন্ধ মিল পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রতি বাস-বায়নের লক্ষে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতায় এককালীন কুষ্টিয়াবাসীর গৌরব মোহিনী মিল পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
ডঃ রাধা বিনোদ পালঃ
ড. রাধাবিনোদ পাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির বিপক্ষে এবং জাপানিদের পক্ষে যুগান-কারী রায় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করায় বাংলাদেশী হিসেবে তাঁকে নিয়ে প্রচণ্ড অহঙ্কার ও গর্ববোধ করা হলেও কুষ্টিয়ার মিরপুর কাকিলাদহ আজও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে তার বাস'ভিটা। ইতোমধ্যে কাকিলাদহের ১৫০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত পৈত্রিক ভিটার ১২০ বিঘা জমি আজ জাল দলিলে হস-ান-রিত। দীর্ঘ ১০০ বছর আগের কিছু স্মৃতি, কিছু চিহ্ন তার বাস'ভিটায় আজ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুস্কর। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সরকার ড. রাধাবিনোদ পালের বাস'ভিটায় সরকারী উদ্যোগে অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরী ও মিউজিয়াম নির্মাণের প্রকল্প বাস-বায়নের কথা বললেও কোনো প্রকল্প আজও বাসত্মবায়ন হয়নি। ফলে এতদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা তাঁর বাস'ভিটা- যার সবকিছুই এখন প্রভাবশালীদের দখলে। এলাকাবাসী মনে করেন, বিভিন্ন সরকারের সময়ে নেয়া প্রকল্পগুলো এখন বাস-বায়ন হলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজেই ড. রাধাবিনোদ পালের জীবনকর্ম ও সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে গবেষণারও অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারী এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রও।
ড. রাধাবিনোদ পাল একজন দুঃসাহসী আন-র্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারপতি। এই দুঃসাহসী ড. রাধাবিনোদ পালের জন্ম ১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের ছলিমপুর গ্রামে। পৈত্রিক নিবাস মিরপুর থানার কাকিলাদহ গ্রামে। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতার মৃত্যুতে দারুণভাবে তার লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অত্যন- আত্মপ্রত্যয়ী ড. রাধাবিনোদ পাল সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় আশাতীত ফল লাভ করেন। জনশ্রুতি আছে এই লেখাপড়া করতে গিয়ে তাকে একটি মেসে পার্টটাইম বাবুর্চিগিরির কাজ করতে হয়েছিল। ছাত্র জীবনে বৃত্তি লাভ না করলে হয়তো তার পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হতো না। ১৯০৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে (সম্মান) প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন- তিনি অধ্যাপনা করেন। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.এম পাস করেন এবং প্রথম স'ান অধিকার করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি লাভ করেন। দারুণ মেধাবী এই মানুষটি অধ্যাপনা থেকে আইন পেশায় প্রবেশ কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এই পেশায় খ্যাতি লাভ করতে পেরেছিলেন। ১৯১৩ সালে ভারতবর্ষে আয়কর আইন চালু হয়। এই আয়কর আইনকে সময়োপযোগী করার পেছনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকারের আয়কর আইন সংক্রান- উপদেষ্টা ও ইউনিভার্সিটি ‘ল’ কলেজের অধ্যাপকও ছিলেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন- তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক এবং ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করেছেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ প্রায়। অক্ষশক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে নুরেমবার্গ এবং টোকিওতে দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। হিটলারের মন্ত্রিপরিষদ এবং যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিচার করা হয় নুরেমবার্গে এবং জাপানের সমরবিদ জেনারেল হিদেকি তোজোর বিচার করা হয় টোকিও ট্রাইব্যুনালে। এই টোকিও ট্রাইব্যুনালে একজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ড. রাধাবিনোদ পাল। বিচারের একপর্যায়ে রাধাবিনোদ পাল বাদে অন্য সব বিচারপতি জেনারেল তোজোকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান- নেন। অন্যান্য সব বিচারপতির ধারণা ছিল, বিচারপতি পালও মিত্র শক্তির পক্ষে অনুগত থাকবেন। কিন' বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের ৮শ’ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় মিত্রশক্তি এমনকি সারাবিশ্বকে হতবাক করে দিল। সবাই ভেবেছিল আন-র্জাতিক গ্লামার অর্জনের জন্য বিচারপতি পাল হয়তো বিচারের নীতিমালা উপেক্ষা করে মিত্রশক্তির পক্ষে রায় দেবেন। আইনের শাসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল এবং বিচার ব্যবস'ার নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বিচারপতি পাল কর্তৃক উপস'াপিত তিনটি প্রশ্ন সমগ্র রায়কে বিতর্কিত প্রমাণ করে আন-র্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রশ্নের বৈশিষ্ট্যগুলো ক. মিত্রশক্তির তিন প্রধান কর্তৃক স'ায়ী শানি-র লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত সি-মিতকরণে প্রথাগত অস্ত্রের অনুশীলন সম্পর্কিত ঘোষণা। খ. আন-র্জাতিক আইনের সংযম ও নিরপেক্ষতার নীতিমালা লঙ্ঘন। গ. জাপানের আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত উপেক্ষা করত ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী আণবিক বোমা ব্যবহার। নুরেমবার্গে বিচার ব্যবস'ায় পক্ষপাতিত্বের দরুণ শংকিত হয়ে উঠেছিলেন বিচারপতি পাল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নুরেমবর্াগের ফলশ্রুতি থেকে টোকিও আদালত নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। সেই প্রেক্ষাপটে এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক। বিচারের রায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৫ সালের ফেব্রয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলনে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল স'ায়ী শানি-র লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দ্রুত সি-মিতকরণে প্রচলিত অস্ত্র প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রতি ব্যক্ত করেছেন। তাহলে কোন যুক্তিতে জাপানের বিরুদ্ধে আণবিক বোমা ফেলা হলো? এছাড়াও জাপান যখন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ই আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে তখন তার উপর পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাত অমানবিক এবং আন-র্জাতিক আইনের পরিপন'ী। জাপানের আত্মসমর্পণের প্রমাণ আদালতের কাছে রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমেরিকা কেন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোসিমায় এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ১২ হাজার কিলোটন উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা সম্পন্ন আণবিক বোমা ফেলে হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে যথাক্রমে ২ লাখ ১৭ হাজার ১৩৭ জন এবং ৭০ হাজার শিশু ও নারীসহ নিরীহ জনগণকে হত্যা করেছে। ওই নির্দিষ্ট সময়ে অনাক্রমণাত্মক অবস'ানে থাকার কারণে জাপান জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট জেনেভা কনভেনশনের আলোকে প্রতিকার পেতে পারে। তিনি তার রায়ে তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে ভর ও গতি তত্ত্বের উদ্ভাবক আলবার্ট আইনস্টাইন ও আণবিক বোমার আবিষ্কারক ওপেন হাইমার প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আণবিক বোমা বিশ্ব শানি- ও মানবতার জন্য অভিশাপ ও হুমকিস্বরূপ। হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমার আক্রমণ ইউরোপে ক্রমাগত স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দেবে। সোভিয়েত রাশিয়াকে ভয় দেখানোর জন্যই এই আণবিক বোমার আক্রমণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল তা সচেতন বিশ্ববাসীকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিলেন। বিচারপতি পালের এই বিপরীতমুখী রায় হয়তোবা জেনারেল তোজোসহ ৭ জনের ফাঁসি কার্যকর করতে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন' মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, শানি- ও আইনের শাসনের পক্ষে অবস'ান নিয়ে পরাক্রমশালী মিত্রশক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিচারপতি পালের এই ঐতিহাসিক, যুগান-কারী ও সাহসী রায় পারমাণবিক ধোঁয়ায় নিমজ্জিত পৃথিবীর ভীতসন্ত্রস- বিজ্ঞান, বিচার ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগণকে সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছিল। যে রাতে জেনারেল তোজোসহ ৭ জনের ফাঁসি দেয়া হয়, পরদিন সকালে টোকিও শহরে রাধাবিনোদের সমর্থনে বিশাল মিছিল বের হয়। জাপানিদের কাছে এখনও রাধাবিনোদ পাল যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। ড. বিনোদপাল নিজের অজ্ঞাতেই দারুণ ভালোবেসে ফেলেছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিধ্বস- জাপানকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ঐতিহাসিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জাপান একদিন অর্থনৈতিক ও শিল্প সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তার এই ধারণা আজ সত্য হয়েছে। আমরা বাঙালিরা ড. রাধাবিনোদ পালকে সম্মান ও স্মরণ না করলেও জাপান কিন' ভোলেনি এই মহাপণ্ডিতকে। তিনি যখন শেষ বারের মতো ১৯৬৬ সালে জাপান সফর করেন তখন রাজপথে অনন্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে অকল্পনীয় সম্মান প্রদর্শন করে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। জাপানে তার স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য গঠিত হয়েছে পাল ফাউন্ডেশন এবং চালু হয়েছে এর উদ্যোগে গৃহীত আন-র্জাতিক আইন ও জুরিসপ্রুডেন্সের বহুমুখী কর্মসূচি। আন-র্জাতিক আইনের পণ্ডিত ড. রাধাবিনোদ পাল পরবর্তী সময়ে একাধিকবার আন-র্জাতিক আইন কমিশনের বিচারপতি ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আইন সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি তিনি একাধিক বই রচনা করেছেন। ঞযব ঐরহফঁ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ষধ িরহ ঃযব ঠবফরপ ধমব, ঞযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ঐরহফঁ ষধ িরহ ঠবফরপ ধমব, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ষধ িড়ভ ঢ়ৎরসড়মবহরঃঁৎব রিঃয ংঢ়বপরধষ ৎবভবৎবহপব ঃড় ওহফরধ ধহপরবহঃ, ষধ িড়ভ ষরসরঃধঃরড়হ, ষধ িড়ভ রহপড়সব ঃধী, পৎরসবং রহ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ৎবষধঃরড়হং তার অন্যতম সৃষ্টি। ১৯৫৯ সালে তিনি পদ্মভূষণ ও জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হন। শেষ জীবনে অনেকটা উপেক্ষিত ও নিঃসঙ্গ বিচারপতি পাল অর্থ সঙ্কটে পড়েন এবং ইনকাম ট্যাক্সের দাবি মেটাতে কলকাতার বাড়ি বিক্রয় এবং শানি-র আশায় পৈত্রিক ভিটা কুষ্টিয়ার কাকিলাদহে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন' পাকিস-ান-ভারত যুদ্ধের ফলে তার পৈতৃক ভিটে শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়। অবশেষে১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারী মারা যান। কাকিলাদহের ১৫০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত পৈত্রিক ভিটার ১২০ বিঘা জমি আজ জাল দলিলে হস-ান-রিত। টোকিও ট্রায়ালে ড. রাধাবিনোদ পালের রায়ের দার্শনিক আবেদনই আজ আণবিক নিরস্ত্রীকরণের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান বিশ্বে যখন পারমাণবিক অস্ত্রধারীদের উন্মত্ততা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যখন অরক্ষিত, অনুন্নত দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যখন প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন তখন বিশ্ব শানি-র প্রয়োজনেই আমাদের ড. রাধাবিনোদ পালের আদর্শ ধরে রাখতে হবে। কিন' আমরা বাঙালি জাতি আত্মবিস্মৃত জাতি। ড. রাধাবিনোদ পাল তার নিজ জন্মভূমিতেই আজ অবহেলিত ও উপেক্ষিত। কিন' জাপানিরা আজও তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। জাপান যে আজ বাংলাদেশের ভালো বন্ধু, এক্ষেত্রে ড. রাধাবিনোদ পালের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়।
বাঘা যতীনঃ
ঃ ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের স্বপ্নের সব নাড়ি কুমারখালীর কয়ার মাটিতে পোঁতা। দীর্ঘ ১০০ বছর আগের কিছু স্মৃতি, কিছু চিহ্ন তার বাস'ভিটায় আজ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুস্কর। ইতোমধ্যে এ মহান বিপ্লবের বাস'ভিটাসহ বেদখল হয়ে গেছে ২২ বিঘা জমি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঘা যতীনের স্বজনেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের সাথে দেখা করলে তিনি বাঘা যতিনের বাস'ভিটায় একটি মিলিটারী একাডেমী স'াপনসহ বেশ কিছু প্রকল্প স'াপনের কথা বললেও কোন প্রকল্প আজও বাসত্মবায়ন হয়নি। ফলে এতদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা তাঁর বাস'ভিটা- যার সবকিছুই এখন প্রভাবশালীদের দখলে। স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর নিজ হাতে নির্মিত একটি থিয়েটার ক্লাব ও একটি ফুটবল মাঠ। এলাকাবাসী মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের সে সময়ে নেয়া প্রকল্পগুলো এখন বাস-বায়ন হলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজেই বাঘা যতীনের জীবনকর্ম ও সঠিক ইতিহাস জানার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে গবেষণারও অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারী এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রও।
বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় মন-ব্য করেছিলেন, আমি বাঘা যতীন ও লেনিন দুজনকেই দেখেছি। এ দুজনের মধ্যে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ। বিপ্লবী এমএন রায় তার এই মন-ব্যের মাধ্যমে মহামতি ভ.ই. লেনিনকে ছোট করেননি বরং বাঘা যতীন যে একজন বিশাল মাপের মানুষ সেটিই তার এই মন-ব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন। পলাশীর প্রান-রে ১৭৫৭ সালে বাংলার সূর্য অস-মিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দেশ ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। প্রায় পৌনে দু’শ বছর শাসন করে ব্রিটিশ। তখন দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে যে ক’জন মহামানব ও মহাবিপ্লবী তাদের জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন এবং জীবন দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বাঘা যতীন অন্যতম। ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে মা শরৎশশী দেবীর কোলে জন্ম নিয়েছিল ছোট্ট শিশু জ্যোতি (বাঘা যতীন)। পরিবারের প্রথম ছেলেসন-ান হওয়ার কারণে শিশু জ্যোতি ছিল পরিবারের আদুরে সন-ান। জন্মের মাত্র পাঁচ বছর পর শিশু জ্যোতি হারান তার পিতা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তার মা ছিলেন একজন সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিত্ব। স্বামীর স্বর্গারোহণ, শ্মশান, সংসার প্রভৃতি কাব্যগ্রনে'র রচয়িতা ছিলেন তিনি। ১৮৯৯ সালে এই মহীয়সী রমণী ছেলে বাঘা যতীন ও মেয়ে বিনোদবালাকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর বোন বিনোদবালা বাঘা যতীনকে মায়ের স্নেহে গড়ে তোলেন। তৎকালীন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করা শিক্ষিত বোন বিনোদবালাও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাঘা যতীনের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তার এই বোন বিনোদবালা। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাঘা যতীন হয়ে ওঠার পেছনে তার মামারা অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে বড় মামা বসন- কুমার মুখোপাধ্যায়। চুয়াডাঙ্গা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রথম জীবনে। পরে তিনি নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত রেখেছিলেন এবং ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাঘা যতীনকে তৈরি করার পেছনে এই মামার ভূমিকা ছিল অসামান্য। ছাত্র হিসেবে দারুণ মেধাবী ছিলেন বাঘা যতীন। কৃষ্ণনগর এভি স্কুলে ভাল রেজাল্ট করে শিক্ষকদের প্রশংসা অর্জন করেন তিনি।
এবারে আসা যাক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কীভাবে বাঘা যতীন নাম ধারণ করলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন গ্রনে' নানা রকম তথ্য দিয়েছেন। তবে তার মূল সারাংশ হচ্ছে এই বাঘা যতীন কয়া গ্রামে একটি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘটিকে মেরে ফেলেন। সেই থেকেই গ্রামবাসী থেকে শুরু করে সারা ভারতবর্ষের মানুষ তার সাহসী ভূমিকার কথা বিবেচনা করে বাঘা যতীন নামে আখ্যায়িত করেন। বাঘা যতীনের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটা সময় কয়া গ্রাম যেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুর্গে পরিণত হয়। বাঘা যতীন সরকারি চাকরিরত অবস'ায় নেপথ্যে অবস'ান করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। ১৯০৮ সালে কলকাতার মানিকতলায় গোপন বোমার কারখানার নেতাকর্মীরা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। এসব নেতাকর্মীর নেতা ছিলেন বাঘা যতীন। কিন' সরকারি চাকরি করার জন্য তাকে সন্দেহ করত না পুলিশ। ১৯০৮ সালেই বাঘা যতীন শিলিগুড়ি স্টেশনে উচ্চপদস' ইংরেজ সামরিক কর্মচারীদের প্রহার করেন। বেশক’টি কারণে বাঘা যতীনের ওপর পুলিশের সন্দেহ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে চিংড়িপোতা রেল ডাকাতির আসামি নরেন ভট্টাচার্যের জন্য ও ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত কুঞ্জলাল সাহার পক্ষে বন্ধু ব্যারিস্টার জেএন রায়কে নিয়োগ, কলকাতার ছোট লাট এন্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার প্রচেষ্টায় ধৃত জিতেন রায় চৌধুরীর সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক, প্রফুল্ল চাকীকে ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে পুলিশ কর্মচারী নন্দলাল বাড়ুজ্যেকে হত্যা, ১৯০৯ সালে সরকার পক্ষীয় উকিল আশু বিশ্বাসকে আলিপুর ফৌজদারি কোর্টে হত্যা করানোর মূল নায়ক ছিলেন বাঘা যতীন- একথা যখন ব্রিটিশরা জানতে পারে তখন তিনি বাংলার গভর্নরের পার্সোনাল সেক্রেটারি। তাঁর এসকল বিপ্লবী পরিচয় জানার পর তাকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়ানো হয়। পনের মাস মামলা চলার পর সরকার তাকেসহ আরও ৪৬ জনকে দোষী সাব্যস- করতে ব্যর্থ হলে ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে বাঘা যতীন মুক্তি পান। সহকর্মী অতুল কৃষ্ণ ঘোষের কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে বাঘা যতীন আন্দোলনের কৌশল পাল্টিয়ে ফেলেন। যশোরে এসে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। আর এই ব্যবসার আড়ালে বিপ্লবের প্রস-ুতি নিতে শুরু করেন। ব্রিটিশের শত্রু জার্মানি তখন বিপ্লবীদের ব্যাপকভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করত। এমন এক সময়ে বাঘা যতীন জানতে পারেন, জার্মান জাহাজ ম্যাভারিক ত্রিশ হাজার রাইফেল, আট লাখ কার্তুজ ও দুই লাখ টাকা নিয়ে জুন মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা করবে। জাহাজের এসব জিনিসপত্র বুঝে নেয়ার জন্য বাঘা যতীন তার সহকর্মীসহ বালেশ্বরের দিকে রওনা করেন এবং এক পর্যায়ে কাপ্তিপোদায় অবস'ান নেন। এ খবর পেয়ে সরকারের লোকজন বালেশ্বর চলে যায় এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম নামে একটি দোকানে তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে বাঘা যতীনের অবস'ান জানতে পেরে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন কাপ্তিপোদার দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ। এত বড় সুসজ্জিত বাহিনী নিয়েও বাঘা যতীনকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয় জেনে তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। চারদিকে তাদের লোক ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার চালায় যে, একদল ডাকাত এই পথ ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে গ্রামবাসীর ধাওয়া খেয়ে, দীর্ঘ নদী সাঁতরে পার হয়ে একটা বনের মধ্যে অবস'ান নেন ক’দিনের প্রায় অভুক্ত বাঘা যতীনসহ তার সহকর্মীরা। বনের ভেতর অবসি'ত একটি টিলা থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেন বাঘা যতীনসহ তার সহকর্মীরা। মাত্র ৪ জন সহকর্মী নিয়ে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ করে যখন বগলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাঘা যতীন ধরা পড়লেন, তখন তার রণকৌশলে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মাথার টুপি খুলে তাকে সম্মান জানিয়েছিল ব্রিটিশ অফিসাররা। ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই অকুতোভয় মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন মৃত্যুবরন করেন। বাঘা যতীনের চেতনায় লালিত হয়ে গোটা ভারতবর্ষে অসংখ্য বাঘা যতীনের জন্ম হয় এবং এক পর্যায়ে এই অসংখ্য বাঘা যতীনের আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন' বর্তমানে কয়া গ্রামে বাঘা যতীনের ভিটেমাটির কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। সেখানে আমাদের দেশ বাঘা যতীনকে ন্যূনতম মূল্যায়নও করে না। এ লজ্জা সমগ্র জাতির। আমাদের প্রত্যাশা, অবিলম্বে বাঘা যতীনকে নিয়ে কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে আলোচনা হবে, তাকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। তবেই একজন বিপ্লবীর প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।
রেণউইক বাঁধ ঃ
শহরের গড়াই নদী সংলগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আখ মাড়াই কলের যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা ছিল রেণউইক অ্যান্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি। ছায়াঘেরা সুন্দর পরিবেশের এই কোম্পানির শেষ প্রানে- নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছে শহর রক্ষা ‘রেণউইক বাঁধ’। শত শত মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। ইচ্ছা করলে নদীতে একটু নৌকা ভ্রমণ করা যায়।
ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ ঃ
দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক স'াপত্য নিদর্শন কুষ্টিয়া ঝাউদিয়া জামে মসজিদ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের জমিদার আহমেদ আলী সুফী নিজ বাড়িতে এই ঐতিহাসিক শাহী মসজিদটি নির্মাণ করেন। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের বৃত্তিপাড়া থেকে পায়ে হেঁটেও এ মসজিদে যাওয়া যায়। আজও এর স'াপত্যকলা ও নির্মাণ কৌশল দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
একের ভিতরে তিন ঃ
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভেড়ামারা পাম্প হাউস ও লালন শাহ সেতুর অবস'ান প্রায় একই স'ানে। শহর থেকে ২৫ কি.মি. দূরে কুষ্টিয়া-পাবনা জেলার মধ্যবর্তী পদ্মাপাড়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় এই তিনটি স'াপনা। পূর্বানুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্পের (জিকে) প্রধান পাম্প হাউসে। এর পাশাপাশি পাবনা এবং কুষ্টিয়া জেলাকে একত্রিত করে রেখেছে যে দুটি অনন্য স'াপনা, তা হচ্ছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন সেতু। দুই সেতুর মধ্যবর্তী পদ্মা পাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা গাবতলী থেকে সরাসরি এসি,নন এসি বাস কুষ্টিয়াতে আসে।ভাড়া ২০০-৩৫০টাকার মতো। কুষ্টিয়াতে থাকার মতো আছে বিভিন্ন ধরণের রেষ্ট হাউস ও হোটেল।
ক্যাপশন ঃ ১) লালন শাহের মাজার ২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের টেগর লজ ৩) মোহিনী মিল ৪) আরও অন্যন্য